কক্সবাজার টাইমস২৪:
দেশের সীমান্ত জনপদ টেকনাফের চিহ্নিত ও আত্মস্বীকৃতি মাদক কারবারীরা আবারো বেপরোয়া হয়ে ওঠেছে। কৌশলে শুরু করেছে অবৈধ ব্যবসা। গড়ছে নতুন সিন্ডিকেট, বেহিসাব সম্পদের পাহাড়। অনেকে মামলার পাহাড় নিয়ে জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হয়েছেন। যে কারণে সহজেই ধরা পড়ছে না স্বঘোষিত ইয়াবা ব্যবসায়ীরা।
খোঁজখবর নিয়ে জানা গেছে, আত্মস্বীকৃত ১০২ জন ইয়াবা কারবারির অন্যতম হ্নীলা পশ্চিম লেদার নুরুল হুদা, যিনি ২০১৯ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারী স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর হাতে বিপুল পরিমাণ ইয়াবা ও অস্ত্রসহ আত্মসমর্পন করেছিলেন। তার বিরুদ্ধে রয়েছে ৩ ডজনের বেশি মামলা। সেখানে বিরাচাধীন মামলার সংখ্যা প্রায় এক তৃতীয়াংশ।
সর্বশেষ ২০২০ সালের ২ মার্চ সম্পদ বিবরণী দাখিল না করা এবং ২,৭১,২৫,৩৩৭ টাকার জ্ঞাত বহির্ভুত সম্পদ অর্জনপূর্বক ভোগ দখলের অপরাধে নুরুল হুদার বিরুদ্ধে মামলা করে দুদক।
মহানগর দায়রা জজ ও চট্টগ্রাম মহানগর সিনিয়র স্পেশাল জজ আজ আদালতে মামলাটি করেন দুর্নীতি দমন কমিশন সমন্বিত জেলা কার্যালয়, চট্টগ্রাম-২ এর সহকারী পরিচালক মো. হুমায়ুন কবীর। যার মামলা নং-৪/২০২০।
সুত্র মতে, নুরুল হুদা টেকনাফের হ্নীলা ৮ নং ওয়ার্ডের টানা ২ বারের নির্বাচিত মেম্বার। গত ২০ সেপ্টেম্বরের নির্বাচনেও বিজয়ী হন। এবারসহ তিনবার। আত্মস্বীকৃত এই ইয়াবা ডন কিভাবে বারবার নির্বাচিত হন, ভাবিয়ে তুলেছে সবাইকে। নুরুল হুদা পশ্চিম লেদার মৃত আবুল কাসেমের ছেলে।
৮ নং ওয়ার্ডের পূর্ব লেদার বাসিন্দা মো. আলম জানান, সাড়ে ৩ লক্ষ ইয়াবাসহ আত্মসমর্পন করেছিলেন নুরুল হুদা। তিনি সীমান্তের ইয়াবা ও চোরাকারবারের এজেন্ট। দুদক, থানা, আদালতের তার নামে অন্তত অর্ধশত মামলা রয়েছে, যার সিংহভাগই মাদকের।
তিনি জানান, নুরুল হুদা এখন শত কোটি টাকার মালিক। বান্দরবানের লামা হারগেজা লম্বাশিয়ায় ১০০ কানির বেশি লিজের জমি কিনেন। ছোট ভাই আবছারের নামে টেকনাফ বিজিবি এলাকায় শতকোটি টাকার জমি ক্রয় করেছেন। নাইট্যংপাড়ায় কোটি টাকা মূল্যের সম্পদ আছে। শালা আবদুর রহমানের নামে লেদায় কিনেছেন মার্কেট। নামে-বেনামে স্কেভেটর, সিএনজি, কারসহ বিভিন্ন জাতের গাড়ি রয়েছে নুরুল হুদার। এত সম্পদ ও অর্থের উৎস কোথায়, তদন্ত করলে সব বেরিয়ে আসবে মনে করেন মো. আলম।
তবে, সব অভিযোগ মিথ্যা দাবি করেন মেম্বার নুরুল হুদা। তিনি বলেন, অভিযোগকারী মো. আলম আমার নির্বাচনী প্রতিপক্ষ। পরাজয়ের পর থেকে অপপ্রচার চালাচ্ছেন। দুদকসহ বিভিন্ন দপ্তরে অভিযোগ দিচ্ছেন। মো. আলমের পরিবারের লোকজনই মাদক কারবারিতে জড়িত। আমার বিরুদ্ধে আনিত সব অভিযোগ মিথ্যা।
মামলার বিষয়ে নুরুল হুদা বলেন, আমার বিরুদ্ধে দায়েরকৃত মামলাগুলো পরিকল্পিত ও ষড়যন্ত্রমূলক। ইতোমধ্যে ৭টি থেকে খালাস পেয়েছি। আরো আছে ১৪টি মতো। কারান্তীর থাকা অবস্থায় দেয়া হয় ৪টি মামলা। সাবেক ওসি প্রদীপ কুমার দাসের ষড়যন্ত্রের শিকার বলেও দাবি করেন নুরুল হুদা মেম্বার।
বহুল আলোচিত আরেক চোরাকারকারী ও মাদক ব্যবসায়ীর নাম বোরহান উদ্দিন (৩০)। বয়সের গণ্ডি বেশি না হলেও অবৈধ কারবারে যথেষ্ট পটু। পশ্চিম লেদার মৃত নুরুল ইসলামের ছেলে বোরহান ২০১৯ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারী স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর নিকট আত্মসমর্পণ করেছিলেন। দীর্ঘদিন কারাভোগ শেষে মুক্ত হয়ে আবারো যুক্ত হন পুরনো পেশায়।
বোরহান উদ্দিনের বিরুদ্ধে ইয়াবা, চোরাচালান, অস্ত্র, হত্যা, মানি লন্ডারিংসহ বিভিন্ন অপরাধে অর্ধশত মামলা বিচারাধীন বলে বিভিন্ন সুত্রে জানা গেছে। এসব বিষয়ে পূর্ব লেদা এলাকার মো. নুরুল হুদা দুদক বরাবর লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন।
অভিযোগে উল্লেখ আছে, স্থানীয় ওমরখালের ব্রিকফিল্ডের পাশে অন্তত ২ কোটি টাকা দামের ১০ কানি জমি ক্রয় করেছেন বোরহান। জাদিমুরা, লেদা ও উখিয়ার মরিচ্যাবাজার এলাকায় ব্রিকফিল্ড রয়েছে। বিতর্কিত সাইফুল করিমের পরিবার থেকে টেকনাফ দমদমিয়া নেচার পার্কের পূর্ব পাশে কিনেছেন ১৭ কানি জমি। লমনীপাড়া, পশ্চিম লেদা ও ওমরখান সংলগ্ন এলাকা মিলে রয়েছে আরো অন্তত ১৫ কানি সম্পত্তি। ভাই, বোন, মামা, শ^শুর বাড়ির লোকজনের নামেও জমিজমা আছে। এসব অঢেল সম্পদ ও টাকার উৎস কোথায়, প্রশ্ন স্থানীয়দের। আত্মস্বীকৃতি মাদক কারবারী বোরহান উদ্দিনের সম্পদ অনুসন্ধানপূর্বক ব্যবস্থা নিতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে এলাকাবাসী।
অভিযোগ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বোরহান উদ্দীন বলেন, স্বেছায় আত্মসমর্পণ করেছি, ঠিক। মাদকের দুইটি মামলা ছাড়া আমার নামে আর কোন মামলা নাই। আমার সব দৃশ্যমান।
তিনি বলেন, প্রায় ২ বছর কারাভোগের পর স্বাভাবিক জীবন যাপন করছি। কোন অবৈধ কাজে জড়িত নাই। জায়গা জমি বিক্রির ‘মিডিয়া’ করে আয়ের টাকায় চলছি। বৈধভাবে জীবন যাপন করছি। নির্বাচনী প্রতিহিংসা থেকে মিথ্যা অভিযোগ করছে। প্রয়োজনে সরেজমিন তদন্ত করে নিউজ করতে প্রতিবেদককে অনুরোধ করেছেন বোরহান।
দেশব্যাপী মাদক সিন্ডিকেটের অন্যতম সদস্য নুরুল কবির (৩৮)। চেহারায় বোঝা যাবে না যে, তিনি একজন মাদক কারবারী। বেশভূষায় ‘ভাল মানুষ’ মনে হলেও তিনি উচ্চ মাপের একজন ইয়াবা ব্যবসায়ী। এই পথ ধরে তিনি এখন শত কোটি টাকার মালিক। নিজেকে ‘নিরাপদ’ রাখতে শালা ও শ্যালিকার নামে ২০ কানি মতো জমি কিনেছেন নুরুল কবির। হ্নীলা মইন উদ্দিন মেমোরিয়াল কলেজের পাশে এইচকে আনোয়ারের সন্তানদের নিকট থেকে ৫ কানি, টেকনাফের হাশেম মেম্বার থেকে ইটভাটাসহ ২৩ কানি জমি ক্রয় করেছেন। যশোরের অভয়নগরেও তার মালিকানাধীন কোটি টাকা মূল্যের সম্পদ রয়েছে।
এসব বিষয়ে জানতে ৪ নভেম্বর সকাল ০৯.৩৭ টায় নুরুল কবিরকে কল (০১৫৭২…৬৬২) দিলে অন্যজন রিসিভ করে। জবাব দেয়, নাম্বার ঠিক। তবে এটি অফিসে থাকে। তিনি মোবাইল ব্যবহার করেন না!
পূর্ব লেদার কামাল উদ্দিন আহমেদ অভিযোগ করেছেন, জাহাঙ্গীর আলমের (৪০) নামক ব্যক্তির বিরুদ্ধে। দিয়েছেন অনেক তথ্য।
তিনি বলেন, জাহাঙ্গীর আলম ‘লেদা টাওয়ার’ এর পূর্ব পাশে বিশাল মার্কেটের মালিক। রয়েছে ৩ তলা বিশিষ্ট ফ্ল্যাটবাড়ি। উখিয়ার পালংখালীতে শ^শুর বাড়ির লোকজনের নামে গাড়ি, বাড়ি ও সম্পদ গড়েছেন। ভাই, বোনের নামে তো আছেই। লেদা টাওয়ারের পশ্চিম পাশে দুই তলা বিশিষ্ট বাড়ির মালিক জাহাঙ্গীর আলম। যার অনুমান মূল্য ৩ কোটি টাকা। পিতা মীর কাসেমের নামে কোটি টাকার একটি বাড়ি রয়েছে। একই এলাকার আবদুশ শুক্কুর ৫ তলা বাড়ি করছেন। ওবাইদুল হকের নামে আছে জমি, মার্কেট। এসব ব্যক্তির সম্পদ অনুসন্ধান করলে নেপথ্যে বেরিয়ে আসবে আরো অজানা রহস্য।
কামাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, অভিযুক্ত ব্যক্তিদের কারণে এলাকার ওঠতি যুব সমাজ নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। তাদের গতিবিধি নজরে রাখা দরকার। পাশাপাশি কালো টাকা বাজেয়াপ্ত ও জ্ঞাত আয়বহির্ভুত সম্পদ অর্জনের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া সর্বমহলের দাবি।
তবে, সব অভিযোগ মিথ্যা দাবি করেছেন জাহাঙ্গীর আলম। তিনি বলেন, যে কোন ব্যক্তির বিরুদ্ধে অভিযোগ থাকতে পারে। সত্য কিনা দেখতে হবে। গত ইউপি নির্বাচনে কামাল উদ্দিন আহামেদ স্বতন্ত্র চেয়ারম্যান প্রার্থী ছিলেন। তার পক্ষে কাজ করিনি। তাই অভিযোগ। আমার কোন অবৈধ সম্পদ নাই। তদন্ত করলে সত্য মিথ্যা বের হবে।
Leave a Reply